বাংলাদেশে প্রায় দুইশত বছরের ইংরেজ শাসনামলই (১৭৫৭-১৯৪৭) ঔপনিবেশিক যুগ হিসাবে পরিচিত। ইংরেজ আমলে বাংলাদেশে অনেক জমিদার বাড়ি, বণিকদের আবাসিক ভবন, অফিস আদালত ভবন, রেলস্টেশন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য স্থাপত্য তৈরি হয়েছিল। ‘প্রত্ন' শব্দের অর্থ হলো পুরনো। প্রত্নসম্পদ বলতে পুরনো স্থাপত্য ও শিল্পকর্ম, মূর্তি বা ভাস্কর্য, অলঙ্কার, প্রাচীন আমলের মুদ্রা ইত্যাদিকে বোঝায়। এসব প্রত্ননিদর্শনের মধ্য দিয়ে সেকালের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা, জীবনযাত্রা, বিশ্বাস-সংস্কার, রুচি বা দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
•ঢাকা শহরে ঔপনিবেশিক যুগে নির্মিত ধর্মীয় স্থাপত্যগুলোর বিবরণ দিতে পারব;
•ঢাকা শহরের কোন কোন অংশে ধর্মীয় ইমারত নির্মিত হয়েছে তা বর্ণনা করতে পারব;
•ঔপনিবেশিক যুগে ঢাকায় নির্মিত উল্লেখযোগ্য লৌকিক ইমারতসমূহের বর্ণনা দিতে পারব; কোন কোন ইমারত সরকারিভাবে আর •কোনগুলো বেসরকারিভাবে নির্মিত হয়েছে তা উল্লেখ করতে পারব;
•ঢাকার বাইরে কোন কোন অঞ্চলে জমিদাররা প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন তা বর্ণনা করতে পারব; ঢাকার বাইরে জমিদারদের তৈরি মন্দির •সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব;
•প্রত্ননিদর্শনের আলোকে ঔপনিবেশিক যুগে সোনারগাঁওয়ের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব ;
•পানামনগর ও সরদার বাড়ির বর্ণনা করতে পারব;
•ঔপনিবেশিক যুগের প্রত্ননিদর্শন কোন কোন জাদুঘর ও সংগ্রহ শালায় রয়েছে তা বর্ণনা করতে পারব;
•জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শনগুলো সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারব ;
•প্রত্নস্থান ও প্রত্নসম্পদের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে এবং এসব সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ হব।
ঔপনিবেশিক যুগের ঢাকার স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি মসজিদ, মন্দির ও গির্জা । ঢাকার মসজিদগুলো মোগল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। তবে এর সঙ্গে কিছুটা ইউরোপীয় রীতিও যোগ হয়েছে। উনিশ শতকে তৈরি ঢাকার উল্লেখযোগ্য মসজিদের মধ্যে রয়েছে লালবাগ (হরনাথ ঘোষ রোড) মসজিদ, লক্ষ্মীবাজার শাহী মসজিদ, সূত্রাপুরের কলুটোলা জামে মসজিদ, বেচারাম দেউড়ি মসজিদ, কায়েতটুলি মসজিদ এবং সূত্রাপুরের সিতারা বেগম মসজিদ। এগুলোর নির্মাণকলা ও বিচিত্র কারুকাজ চিত্তাকর্ষক। নারিন্দার চিনি টিকরি মসজিদও স্থাপত্যশিল্পের চমৎকার নিদর্শন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত শিয়াদের ইমামবাড়া, হোসেনি দালান ইংরেজ আমলে নতুন করে নির্মিত হয় ।
ঢাকা শহরের বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির ও রমনা কালীমন্দির ঔপনিবেশিক যুগের আগে তৈরি। রমনার কালী মন্দিরটি অবশ্য ঔপনিবেশিক আমলে আবার নতুন করে নির্মিত হয়েছিল। আঠারো-উনিশ শতকে ঢাকা শহরে তৈরি হয় বেশ কয়েকটি গির্জা। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো হলো আর্মেনিয়ান গির্জা। এটি তৈরি হয় আরমানিটোলায় ১৭৮১ সালে। উনিশ শতকে ঢাকায় নির্মিত হয় সেন্ট টমাস এ্যাংলিকান গির্জা ও হলিক্রস গির্জা। এছাড়াও ঢাকার পুরনো স্থাপত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে সদরঘাট এলাকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্ক । উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকার নওয়াব আবদুল গণি এ পার্ক তৈরি করে ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়ার নামে এর নাম দেন ভিক্টোরিয়া পার্ক। তার আগে এ জায়গাটির নাম ছিল আন্টাঘর ময়দান । আন্টাঘর ময়দানের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এদেশীয় সৈন্যরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেন। ইংরেজরা একে বলে সিপাহি বিদ্রোহ। যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যরা জিততে পারেন নি। বিদ্রোহী সৈন্যদের যাঁরা ঢাকায় ইংরেজদের হাতে বন্দি হন তাঁদের ইংরেজরা এই আন্টাঘর ময়দানে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। এই ঘটনার ঠিক একশো বছর পর ১৯৫৭ সালে স্বাধীনতার জন্য জীবনদানকারী সৈনিকদের স্মৃতিতে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়। ভারতবর্ষের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নামে পার্কটির নাম হয় বাহাদুর শাহ পার্ক।
ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যকীর্তির আরেকটি বিখ্যাত নিদর্শন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকার নওয়াবদের তৈরি প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল। এছাড়া জমিদার ও বণিকদের তৈরি পুরনো ঢাকার রূপলাল হাউস এবং রোজ গার্ডেনও চমৎকার স্থাপত্যকর্ম। অফিস বাড়ি হিসাবে ঢাকায় যেসব ভবন তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে কার্জন হল। ইংরেজ আমলে তৈরি এ ভবনটি বহুকাল ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অংশ। পুরনো হাইকোর্ট ভবনটিও ইংরেজ আমলে তৈরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের চত্বরে অবস্থিত গ্রিক সমাধিসৌধটি ১৯১৫ সালে নির্মিত। বর্গাকার ও সমতল ছাদযুক্ত এ স্থাপত্যে প্রাচীন গ্রিসের ‘ডরিক রীতি' অনুসৃত হয়েছে।
কাজ : ঢাকা শহরের কয়েকটি প্রধান প্রত্ননিদর্শনের নাম উল্লেখ করো।
সুলতানি আমলে বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। পরবর্তীকালে মোগল যুগে এর গুরুত্ব কমে যায়। কিন্তু তখনো মসলিন শাড়ির উৎপাদন ও ব্যবসাকেন্দ্র হিসাবে এর খ্যাতি ছিল। উনিশ শতকে ধনী ব্যবসায়ীদের অনেকে বসবাসের জন্য সোনারগাঁওয়ের পানাম এলাকাটি বেছে নেন। এরা পানামের মূল সড়কের দুইপাশে সারিবদ্ধভাবে অনেক ঘরবাড়ি নির্মাণ করেন। পানাম নগরে এখনও এ রকম ৫২টি ইমারত টিকে আছে। চওড়া পথের দুই পাশে ইমারতগুলো সুন্দরভাবে সাজানো। পথের উত্তর পাশে ৩১টি এবং দক্ষিণ পাশে রয়েছে ২১টি ইমারত। এর মধ্যে কয়েকটি বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত । এলাকার নিরাপত্তার জন্য পানামের অধিবাসীরা ইমারতগুলোর চারপাশ ঘিরে পরিখা খনন করেছিল। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই ভবনগুলোতে ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করা হয়। তবে এদের নির্মাণকলায় মোগল স্থাপত্যেরও প্রভাব আছে। অনেক অট্টালিকা সাজানো হয়েছিল রঙিন মোজাইকে।
পানামের আশেপাশে আরও কয়েকটি চমৎকার ইমারত এখনও টিকে আছে। এগুলো তৈরি করেছিলেন স্থানীয় জমিদার ও ব্যবসায়ীরা । এগুলোর মধ্যে সরদারবাড়ি, আনন্দমোহন পোদ্দারের বাড়ি ও হাসিময় সেনের বাড়ি উল্লেখযোগ্য।
সরদারবাড়ি বা বড় সরদারবাড়িতে এখন স্থাপিত হয়েছে লোকশিল্প জাদুঘর। এ বাড়ির নির্মাণকাল ১৯০১ সাল। এটি তৈরি হয়েছে দুইটি বড় প্রাসাদকে নিয়ে। একটি করিডোর বা লম্বা বারান্দা দিয়ে প্রাসাদ দুইটি একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দোতলা এই বাড়িতে রয়েছে ৭০টি কক্ষ। রঙিন মোজাইকের নানা কারুকাজে শোভিত হয়েছে সরদারবাড়ি।
সোনারগাঁওয়ের বাইরেও বাংলাদেশের নানা জায়গায় জমিদারদের তৈরি কিছু অনুপম সুন্দর প্রাসাদ ও স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। যার মধ্যে ময়মনসিংহের শশীলজ একটি। মুক্তাগাছার জমিদাররা এটি তৈরি করেছিলেন। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ায় বালিয়াটির জমিদারবাড়িও সেরকম আরেকটি চমৎকার স্থাপত্যকর্মের নিদর্শন। রংপুরের তাজহাট জমিদার বাড়িও বেশ বিখ্যাত। নাটোরের দিঘাপতিয়ার জমিদারের প্রাসাদও তার চমৎকার স্থাপত্যকর্মের জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এটি এখন উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। তাজহাট ও নাটোরের দুইটি প্রাসাদই বর্তমানে স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
কাজ : ঢাকার বাইরের কয়েকটি স্থাপত্যকীর্তি উল্লেখ করো।
বাংলাদেশের পুরাকীর্তিগুলো থেকে পাওয়া অনেক প্রত্ননিদর্শন জাদুঘরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়। এসব প্রত্নসম্পদ দেখে দেশের পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। ঢাকায় রয়েছে আমাদের জাতীয় জাদুঘর। এছাড়া নানা প্রত্নস্থলের জাদুঘরেও রয়েছে প্রচুর প্রত্নসম্পদ। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের গ্যালারিতে সারা দেশে প্রত্ননিদর্শনের সঙ্গে প্রদর্শন করা হয়েছে বাংলার নবাব, জমিদার ও ইংরেজ শাসনকালের বেশ কিছু প্রত্নসম্পদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দিনাজপুরের মহারাজার ব্যবহার করা দ্রব্য ও হাতির দাঁতের কারুকাজ করা শিল্পদ্রব্য। বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর সংগ্রহ থেকে আনা পোশাক, হাতির দাঁতের নানা কারুকাজ করা দ্রব্য ও ঢাল-তলোয়ার। এছাড়া এখানে রাখা হয়েছে নাটোরের দিঘাপতিয়ার জমিদারদের ব্যবহার করা দ্রব্য, পোশাক, ঢাল-তলোয়ার ও সিংহাসন এবং ঢাকার নওয়াবদের ব্যবহার করা কারুকার্যখচিত পোশাক ও জিনিসপত্র ।
কোনো কোনো আঞ্চলিক জাদুঘর ও সংগ্রহশালায় নানা প্রত্ননিদর্শন প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে। অধিকাংশ সংগ্রহশালাই জমিদারদের পুরনো প্রাসাদে অবস্থিত। জমিদারদের ব্যবহার করা নানা দ্ৰব্য এবং তাদের সংগ্রহ করা নানা প্রত্নসম্পদ সেখানে প্রদর্শন করা হয়।
বর্তমানে ঢাকার আহসান মঞ্জিল একটি জাদুঘর। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে ঢাকার নওয়াবদের পোশাক, খাট-পালঙ্ক, চেয়ার, সোফা, অলঙ্কার ও আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে। ময়মনসিংহ শহরে জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের জমিদারদের ব্যবহার করা জিনিসপত্রই এখানে স্থান পেয়েছে বেশি।
মুক্তাগাছার জমিদারদের প্রত্নসম্পদ ময়মনসিংহ জাদুঘরে সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পাথরের ফুলদানি, কম্পাস, ঘড়ি, অলঙ্কার, মৃৎপাত্র, কাপড়বোনার যন্ত্র, লোহার সিন্দুক, খেলার সরঞ্জাম, সরস্বতী ও বিষ্ণুমূর্তি, বাঘ, ড্রাগন, বন্য ষাঁড় ও হরিণের মাথা, সোফাসেট ও ইটালিতে তৈরি মূর্তি ইত্যাদি।
বর্তমানে রংপুরের তাজহাট জমিদারদের প্রাসাদও একটি জাদুঘর। এখানে উত্তরবঙ্গের প্রত্ননিদর্শনের সঙ্গে তাজহাট জমিদারদের ব্যবহার করা দ্রব্যসামগ্রী, সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় লেখা পাণ্ডুলিপি স্থান পেয়েছে।
কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে স্থান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিজড়ানো নানা নিদর্শন এবং আলোকচিত্র।
কাজ : বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রত্ননিদর্শনগুলোর তালিকা তৈরি করো।
আরও দেখুন...